ড. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ | শুক্রবার, ০১ মার্চ ২০২৪
পয়গম্বর হযরত ইব্রাহিম প্রদত্ত একেশ্বরবাদ এবং আসমানী কেতাব অনুসরণকারী ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী, যাদের নবী যথাক্রমে হযরত মুসা আ: (ধর্মগ্রন্থ তাওরাত), হযরত ঈসা আ: (ধর্মগ্রন্থ বাইবেল) এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ আ: ( ধর্মগ্রন্থ কোরআন) তাঁরা সবাই জেরুজালেমকে অত্যন্ত পবিত্র স্থান বিবেচনা করে। চতুর্থ শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তির সুযোগ নিয়ে খ্রিস্টানদের মূল দুই ধারার ধারক-বাহকদের মধ্যে নগরীটির দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। রোমান ক্যাথলিক বা রোম-কেন্দ্রিক পোপের অনুসারী এবং কনস্টান্টিনোপল অর্থডক্স খ্রিস্টানদের মধ্যে জেরুজালেমের আধিপত্য নিয়ে বিবাদ কয়েক শতাব্দী চলমান ছিল। জেরুজালেম মিশরের অধীনস্থ ছিল দীর্ঘ সময়। শান্তির সময় ছিলো সেটি, কারণ ইহুদি যাদের আদি বাসস্থান ছিল এ নগরী তারা যেমন নিরাপদে ধর্মকর্ম করতে পারত তেমনি দুই মতে বিশ্বাসী খ্রিস্টানরাও নির্ভয়ে যিশুখ্রিস্টের প্রিয়ভূমি ও পবিত্র স্থাপনাগুলোতে উপাসনা করতে পারতো। তবে, মিশরীয় সুলতানদের করায়ত্তে জেরুজালেম থাকার ব্যাপারটি পোপের কাছে ছিল চরম অবমাননাকর। কারণ হিসেবে বলা হয় যিশুখ্রিস্টের জন্ম, লালন-পালন এবং তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া – সব ঘটনাই ঘটেছিল জেরুজালেমে।
স্মৃতিকাতর খ্রিস্টীয় মন-মানসিকতাকে উস্কে দিয়ে যে দুই শত বছরের ও বেশি সময়ব্যাপী ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড শুরু হয়েছিল তার জের হিসেবে ইউরোপের সম্মিলিত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী রাজ-রাজড়াদের হাতে প্রথম ক্রুসেডের পরিণতিতে জুলাই ১০৯৯ সালে জেরুজালেম মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। শিয়া- সুন্নি দ্বন্দ্ব, কায়রো এবং সিরিয়ার শাসকদের মধ্যে অমিল ও রেষারেষি ক্রিষ্টানদের জয়ের পথ সুগম করে দিয়েছিল । ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, প্রথম ধর্মযুদ্ধের সময় সুন্নি এবং শিয়া মতাবলম্বী মুসলমান, কুর্দি, মিশরীয়, আরববাসী জনসাধারণ এবং তুর্কিদের মধ্যে ন্যূনতম সংহতি থাকলেও ক্লুনিয়াক সাধু যাজক হাইলডেব্রেন্ড, যিনি পোপ ষষ্ঠ গ্রেগরি (Pope Gregory Vll) নাম ধারণ করে রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পদে অধিষ্ঠিত হন, তার নেতৃত্ব প্রথম ক্রুসেডে জয় লাভ করা সম্ভব হতো না ।
১০৫২ থেকে ১০৯৯ সময় পর্যন্ত বিস্তৃত এ ক্রসেডে লক্ষ লক্ষ লোক নিহতা গেছে। নৃশংসতার মর্মস্পর্শী নজীর এ সময়ের ইতিহাস সম্বন্ধে যারা অল্পবিস্তর জানেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, এটি ছিল মানবজাতির অন্যতম কলঙ্কজনক এক অধ্যায়। পোপ আরবান দ্বিতীয় প্রথম ক্রুসেডকে পবিত্র যুদ্ধ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের কাছে মুসলমানদের ‘রহভরফবষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে অত্যন্ত হিংস্রতার সাথে প্রথম ক্রুসেড পরিচালিত হয়। জেরুজালেমের দায়িত্বে থাকা মিশরীয় আমীর আত্মসমর্পণ করলে নগরীটি খ্রিস্টানদের হাতে চলে যায়। গাজী সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে এর পরবর্তী সময়ে জেরুজালেম পুনরায় তাদের দখলে আসে। ততদিনে অবশ্য তিনটি ক্রুসেড সংঘটিত হয়েছে; সীমাহীন নৃশংসতা ঘটেছে এবং অগুনতি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান প্রাণ হারিয়েছে। শেষোক্ত ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে অর্থ ও সম্পদ, রাজ্য, দুর্গ দখল এসব নিয়ে বিবাদ, যুদ্ধ এবং হতাাকাণ্ডে, অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, নিহতের সংখ্যা ছিল জেরুজালেম দখল নিয়ে ধর্মযুদ্ধে নিহতদের চেয়ে বেশি।
নিবন্ধটির শেষ কথা হলো, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর ৬ তারিখে আমেরিকার প্রাক্তণ প্রেসিডন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমে ইসরায়েল রাষ্ট্রের রাজধানী স্নানান্তরে সানন্দ স্বীকৃতি দিলে তা দুইশত বছরের ক্রুসেডের ইতিহাসকে ম্লান করে দেয়। ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের স্বীকৃতিকে আরও পাকাপোক্ত করে। ইষ্ট জেরুজালেমে প্যালেস্টাইন ও পশ্চিম তীরের রাজধানী হওয়ার যে প্রসঙ্গ তা ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্থাপন করার কোন কারণ খুঁজে পাননি বলে মনে হচ্ছে ।
Posted ৩:১৫ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০১ মার্চ ২০২৪
Weekly Bangladesh | Weekly Bangladesh